বাংলা গানে, বাঙালির প্রাণে বিপ্লব এসেছিল তাঁরই হাত ধরে। বজ্র-বিদ্যুৎ-ফুলের সৃষ্টিসুখের উল্লাসে তাঁর বাণী-সুর আজও বাঙালির অদ্বিতীয় আশ্রয়। স্বাধীনতা, সাম্যের আর অধিকারের আকাক্সক্ষায় উদ্বেল বাঙালিকে রাজপথে নামিয়ে এনেছে তাঁর গান, সুর। বারংবার। স্রেফ সংগ্রাম-সমর-রাজপথেই নয়, তাঁর গান ছাড়া আজও বাঙালির উৎসব সাধিত হয় না। বাঙালির, বাংলার গীতল মর্মের সহচর তিনি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল-সংগীত সংগ্রহে বিপুল গবেষণার পরে সংকলিত হয়েছে তাঁর তিন সহস্রাধিক গান যার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে নজরুলের আত্ম-পরিচয় ও মানবিকতা।
.
গীতিকার, সুরকার, স্বরলিপিকার, সংগীতশিল্পী, সংগীতপরিচালক, রাগস্রষ্টা—কোন প্রিয় নামে বাঙালি ডাকবে তাঁকে? জাগরণী গান গেয়ে তিনি যেমন ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, তেমনি তাঁর শান্ত কোমল গীতি বাঙালিকে দিয়েছে নব রসের সন্ধান। প্রাণের পরশে, প্রচণ্ড প্রতিভায় নজরুল বাঙালির চেতনাকে দিয়েছেন সুরের ভাষা। বাংলার-বাঙালির বিপদে-সম্পদে, সুখে-দুঃখে, আনন্দ-বেদনায়, উৎসবে-উদ্যাপনে, সংগ্রামে-মিলনে নজরুলের গানেই যে মেলে ত্রিভুবনের সুর। প্রথম যৌবনে লেটোর দল থেকে সুরের সঙ্গে সংগত তাঁর। ক্রমে সেই সুরের ধারায় মিশেছে বিশ্ব নিখিলের নানা ধারা, শত যজ্ঞ। যাতে ছিল নবতম বিনোদন মাধ্যম চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনাও। সংগীতসাধক নজরুল ছিলেন যেন এক কল্পবৃক্ষ। যার অবিশ্বাস্য সৃষ্টিশীলতায় সোনা-রুপা-হীরে-মানিক-মুক্তোর মতো রকমারি গানের ফুল ফুটেছে, মন ভরিয়েছে সুরপিয়াসীদের। নজরুলের গানে, নতুন রাগের সৃজনে মাত্র ১৩ বছরে বাংলার গানের ভাণ্ডার হয়েছে সমৃদ্ধ। ছিলেন প্রবলভাবে যৌবনের কবি। যৌবনধর্মের বিদ্রোহ, প্রেম প্রকাশে তাই তিনি আজও প্রাসঙ্গিক। তাঁর সুরের নিশানবাহী হয়ে অজ্ঞানের, ভীরুতার, আত্মবিস্মৃতির কালঘুমের ঘোর কাটিয়েছে একটি জাতি। বাঙালির সত্যের, সুচেতনার, মুক্তির যাত্রায় দিশা দিয়েছে, দিচ্ছে তাঁরই অমর সুর ও গীতি।
Book Name : | সংগীতসংগ্রহ । কাজী নজরুল ইসলাম |
Authors : | কাজী নজরুল ইসলাম |
Publisher: | Inhouse book |
Edition: | 1st Edition September 2025 |
ISBN Number: | 978-984-95043-6-8 |
Total Page | 1192 |
স্বাধীনতা, মানবতা, প্রেম ও বিপ্লব ছিল তাঁর অনন্য সাধারণ সাহিত্যের মূল সুর। লেখক হিসেবে ছিলেন মৌলবাদ, বর্ণবাদ, লিঙ্গবিদ্বেষ ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি সংগ্রামে, আন্দোলনে, বিশেষত মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। কাজী নজরুল ইসলাম। জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায়। বাংলা সাহিত্যের চিরবিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও নজরুল ছিলেন একাধারে সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, রাজনীতিবিদ, গায়ক ও অভিনেতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনের সৃষ্টিশীল সৈনিক নজরুল ‘লাঙল’, ‘নবযুগ’ ও ‘ধূমকেতু’র মতো সংবাদপত্রও সম্পাদনা করেছেন। কবিতার জন্য গিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদীর কারাগারে। আদর্শের বলে লড়েছেন নির্বাচনে। অসংখ্য বিচিত্র রাগ-রাগিণীর স্রষ্টা সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে রচেছেন তিন হাজারের বেশি গান। দেশাত্মবোধক গান, শ্যামাসংগীত, গজলে তাঁর জুড়ি বাংলায় আজও নেই। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সম্মানসূচক ডি.লিট’, ভারতে ‘পদ্মভূষণ’, বাংলাদেশে ‘একুশে পদক’ ও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত হন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয় চিরবিদ্রোহী কবিকে।