বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনুরাগ শুধু দেশ-বিদেশের সাহিত্যের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না, তাঁর গভীর আগ্রহ ও পাণ্ডিত্য ছিল ইতিহাস, ভাষাতত্ত্ব, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব থেকে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিবিধ বিষয়ে। তাঁর প্রবন্ধগুলির বিষয়-বৈচিত্র্যে এবং সেই সঙ্গে তাঁর জ্ঞানের গভীরতায় পাঠক মুগ্ধ ও বিস্মিত না হয়ে পারেন না। তাঁর এই পাণ্ডিত্যের কারণেও তিনি সমসাময়িক কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
বর্তমান গ্রন্থে সংকলিত প্রবন্ধগুলি সম্পর্কে লেখক জানিয়েছিলেন-ইতিহাস-সমাজ-সংস্কৃতিতে এগুলি তাঁর ‘ব্যগ্র অন্বেষণ মাত্র, কোনও সিদ্ধান্ত নয়’। এছাড়া ‘মুসলিম চিত্রকলার আদিপর্ব’ প্রবন্ধটিতে তিনি তাঁর অন্বেষণ সীমাবদ্ধ রেখেছেন এই বিশেষ চিত্রকলার আদিপর্বেই। এই প্রবন্ধ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য এখানে উদ্ধৃত করা হলো-“বিদেশি স্থান-নাম, ব্যক্তি-নাম এবং বহু টার্মের উচ্চারণভিত্তিক বানান তথা প্রতিবর্ণীকরণে সমতা রাখা যায়নি। এটা নিশ্চয়ই ত্রুটি। কিন্তু সমস্যা হলো, সাবেক ইংরেজ কলোনির লোক আমরা ইংরেজি অর্থাৎ অ্যাংলিসাইজ্ড্ উচ্চারণভিত্তিক বানানে অভ্যস্ত। তাই বহুশ্রুত ‘হেরোডোটাস’-কে ‘ঈরদতস্’ কিংবা ‘প্লেটো’-কে ‘প্লাত’ লিখলে ঝুটঝামেলা বাধত।”
সেই মুসলিম চিত্রকলার আদিপর্ব এবং সেই সঙ্গে তার সমসাময়িক সমাজ-জীবনের এক ঘনিষ্ঠ ইতিহাস বিধৃত হয়েছে এই গ্রন্থের অন্যতম প্রবন্ধগুলিতে।
Book Name : | প্রবন্ধ সংগ্রহ |
Authors : | সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ |
Publisher: | Inhouse book |
Edition: | 1st Edition, February 2016 |
ISBN Number: | 9789849118626 |
Total Page | 0 |
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের জন্ম ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে। ছাত্রজীবনে বামপন্থী রাজনীতি ও ভারতীয় গণনাট্যসংঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পদ্য থেকে গদ্য লেখায় পেঁৗছান পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে। প্রারম্ভেই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৬৬—তে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নীলঘরের নটী’ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত উপন্যাস, গল্প সংকলন ও প্রবন্ধের বই মিলিয়ে দুই শতাধিক। সিরাজ ছোটদের জন্যও প্রচুর লিখেছেন। তাঁর রহস্যকাহিনির নায়ক প্রকৃতিবিজ্ঞানী কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বড় ও ছোটোদের মধ্যে অতি জনপ্রিয় চরিত্র। সাহিত্যে স্বীকৃতি হিসেবে সিরাজ পুনঃপুনঃ পুরস্কৃত হয়েছেন। তাঁর ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাস ‘ভুয়ালকা’ পুরস্কার, ‘বঙ্কিম পুরস্কার’ এবং ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কারে সম্মানিত। ‘অমর্ত প্রেমকথা’—র জন্য তিনি পেয়েছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নরসিংহদাস স্মৃতি’ পুরস্কার। এছাড়া ‘আনন্দ’ পুরস্কার, ‘বিভূতিভূষণ স্মৃতি’ পুরস্কার, দিল্লির ঙটঋ সংস্থার ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ পুরস্কার, ‘শরৎচন্দ্র স্মৃতি’ পুরস্কার ইত্যাদি আরও অনেক পুরস্কার সিরাজ তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকৃতীর জন্য পেয়েছেন। এ ছাড়া শৈলজানন্দ জন্মশতবার্ষিকীতে তিনি পেয়েছেন ‘শৈলজানন্দ স্মৃতি’ পুরস্কার। কর্মজীবনে প্রায় পঁচিশ বছর সাংবাদিক হিসেবে আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে চার মাস আমেরিকায় ছিলেন। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের লেখায় ব্যক্তি এবং সমাজ, ব্যক্তি এবং প্রকৃতির দ্বন্দ্ব—সমন্বয়ের চিত্র ফুটে ওঠে। তিনি ব্যক্তির আদি সত্তার মধ্যে নিহিত জৈবিকতার উত্তরণ ঘটান মানবিকতায়। ইংরাজিসহ ভারতীয় এবং অজ¯্র গল্প অনূদিত হয়েছে। বিদগ্ধ পাঠক ও সমালোচকদের মতে অবশ্য ছোটগল্পেই সিরাজের অধিকতর সিদ্ধি। তাঁর ছোটগল্পের প্রায় অনিবার্য পটভূমি বাংলার নিম্নবর্গীয় গ্রামজীবন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর গূঢ় অন্বেষণ মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক। এই সূত্রেই এ দেশের জনজীবনের আর্থ—সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের রূপরেখা তাঁর কলমে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। ফুটে উঠেছে ঐতিহাসিক রূপান্তর ও পালাবদল। ২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর লেখকের জীবনাবসান হয়।