শুদ্ধতম কণ্ঠে জীবনানন্দ দাশ তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বাংলাদেশে তিনি বাংলার মাটির স্বায়ত্ত সন্তান।’ যিনি লিখেছিলেন- ‘গাহি সাম্যের গান, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ সাম্যবাদী-সব্যসাচী- বিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম। আজন্ম লালন করেছেন অসাম্প্রদায়িক মানবচেতনা। অসম, অস্থিতিশীল এবং অবজায়ক্ষম পৃথিবীতে যে কবির অবস্থান সর্বদা বঞ্চিত-লাঞ্ছিতের পাশে, পক্ষে। উৎপাদনের কূটাভাষে ন্যায়ের পক্ষে, ইনসাফের পক্ষে তিনি অনড়। শ্রম ও পুঁজির অসাম্যের নিন্দায় যিনি দ্ব্যর্থহীন। নজরুলের সাম্যচিন্তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সাম্যবাদীর কবিতা একাদশ। মানবিকতার প্রাসঙ্গিকতায় সোচ্চার হয়ে যেখানে নজরুল বলেছেন-মানবিকতাই মানুষের সবচেয়ে বড় ধর্ম। লিখেছেন মন্দির, মসজিদ, গির্জা বা অন্যান্য তীর্থক্ষেত্রের মতোই পবিত্র মানবহৃদয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রচার করেছেন সাম্যবাদের বাণী। সমাজে উদার মানবতাবাদী পবিত্র আত্মার উদ্বোধনের কামনায় লড়েছেন তরবারির মতো ঝলসে ওঠা কলম হাতে। বাংলার মাটি থেকে জেগে, এই মৃত্তিকাকে সত্যিই ভালোবেসে, প্রান্তিক মানবধর্মের জয়ে শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি ছিলেন তিনি। বিপ্লবে, বিদ্রোহে, সাম্যে বাংলার-বাঙালির আস্থার, ভরসার একান্ত আপনজন।
১৯২৫। সাম্রাজ্যবাদী রক্তচক্ষুকে হেলা করে, বিপ্লবের স্বপ্নে স্বরাজ দল গড়লেন নভেম্বরে। পরের মাসে প্রকাশ পেল একটি কবিতার বই ‘সাম্যবাদী’। সমতার স্বপ্ন, সাম্যের লড়াইয়ের আহ্বান জানিয়ে। সাহসী তেজোদীপ্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের, শোষিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামের। মুক্তির-সাম্যের-মর্যাদার লড়াইয়ের সাহসী-দৃঢ়-বলিষ্ঠ কাব্যিক এক ইশতেহার। সকল মত, সকল পথের উপরে যেথা স্থান পেয়েছে মানবিকতা। বৈষম্যহীন অসাম্প্রদায়িক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষায়, কাব্যের শিল্পগুণে, বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তিতে, শতবর্ষ পেরিয়ে আজও অনন্য এক কাব্যগ্রন্থ।
Book Name : | সাম্যবাদী |
Authors : | কাজী নজরুল ইসলাম |
Publisher: | Inhouse book |
Edition: | 1st Edition October 2024 |
ISBN Number: | 978-984-99198-1-0 |
Total Page | 52 |
স্বাধীনতা, মানবতা, প্রেম ও বিপ্লব ছিল তাঁর অনন্য সাধারণ সাহিত্যের মূল সুর। লেখক হিসেবে ছিলেন মৌলবাদ, বর্ণবাদ, লিঙ্গবিদ্বেষ ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি সংগ্রামে, আন্দোলনে, বিশেষত মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। কাজী নজরুল ইসলাম। জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায়। বাংলা সাহিত্যের চিরবিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও নজরুল ছিলেন একাধারে সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, রাজনীতিবিদ, গায়ক ও অভিনেতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনের সৃষ্টিশীল সৈনিক নজরুল ‘লাঙল’, ‘নবযুগ’ ও ‘ধূমকেতু’র মতো সংবাদপত্রও সম্পাদনা করেছেন। কবিতার জন্য গিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদীর কারাগারে। আদর্শের বলে লড়েছেন নির্বাচনে। অসংখ্য বিচিত্র রাগ-রাগিণীর স্রষ্টা সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে রচেছেন তিন হাজারের বেশি গান। দেশাত্মবোধক গান, শ্যামাসংগীত, গজলে তাঁর জুড়ি বাংলায় আজও নেই। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সম্মানসূচক ডি.লিট’, ভারতে ‘পদ্মভূষণ’, বাংলাদেশে ‘একুশে পদক’ ও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত হন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয় চিরবিদ্রোহী কবিকে।