১৯২০ সালের মার্চে ভাঙল ৪৯ বাঙালি পল্টন। ঘরমুখো হলেন উচ্ছ্বসিত এক তরুণ, সঙ্গে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। কাজী নজরুল ইসলাম। এলেন, লিখলেন, জয় করলেন। বাংলার সাহিত্যাকাশে উদ্ভাসিত হলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও শক্তিতে। ভবিষ্যতের বাঙালির জন্য তিনি উচ্চকণ্ঠে উদাত্তস্বরে দ্রোহের বিপ্লবের সংগ্রামের বাণী অবিরাম উচ্চারণ করেছেন। নজরুল যেন জানতেন, যুগে যুগে অমোঘ কালবেলায় রুদ্রের আবাহনে বাঙালিমাত্রে শরণ নেবে তাঁর। ‘বাঁধনহারা’, ‘মৃত্যুক্ষুধা’ আর ‘কুহেলিকা’-তিন উপন্যাসেই রণক্লান্ত বিদ্রোহীর সৃজনশক্তির অসীমত্বের সন্ধান মেলে।
নজরুল বজ্র-বিদ্যুতে ঝড় তুলেছেন বাঙালির মনে-প্রাণে, চির তারুণ্যের-যৌবনের। উদ্দাম, উচ্চকণ্ঠ, কোলাহলময় ভাষায়। প্রবল প্রসন্ন প্রাণের পরিপূর্ণ প্রতীক হয়ে। তাঁর দুর্বার প্রাণশক্তি ভাষায় এনেছে তীক্ষ্ণতা, ছন্দে এনেছে জীবনস্পন্দন, ভাবে এনেছে বল-বীর্য ও তেজের উদ্দীপ্তি। কুড়ি বছরের সৃষ্টিশীল জীবনে উপন্যাস মাত্র তিনটি। আর সেই তিনটি উপন্যাসেই তিনি অনন্য-অসামান্য। নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রাম উঠে এসেছে নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’য়। বঞ্চিত দলিত ও প্রান্তবাসী জনগোষ্ঠীর কথা তীব্রভাবে সঞ্চারিত করেছে তাঁর আয়ুধকে। ‘বাঁধনহারা’র বিপ্লবের আকাক্সক্ষা কিংবা ‘কুহেলিকা’র তীব্র রোমান্স- ঔপন্যাসিক নজরুলের সামর্থ্যকেই পুনঃপ্রতিভাত করে। বাংলা কথাসাহিত্যের দিগন্তে যা অতুলনীয়। ঔপনিবেশিক শাসনামলের জটিল সময়-সংক্রান্তিতে বাংলার সাহিত্য-রাজনীতিতে আবির্ভাব তাঁর অথচ স্বকালের অপরাপর সাহিত্যিকের ন্যায় তিনি নিছক অনুগামী নন। ভিন্নতার সাধনায় নজরুল অতিক্রম করেছেন দীর্ঘ-দুরূহ পথ। মহৎ স্রষ্টা-লেখক, কবি, শিল্পী বাঁচেন তাঁর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারের মধ্যে, সৃষ্টির মধ্যে। জনচিত্তে তাঁর স্থায়িত্ব নির্ণীত হয় সেই অনপনেয় চিহ্ন থেকেই। কালের সে বিচারে বাঙালির জীবনে, বিশে^র সাহিত্যাকাশে কাজী নজরুল ইসলাম অনন্য, অমোচনীয়। বাঙালি সমাজের ধর্মভেদবুদ্ধিহীন এক মিলিত, সমন্বিত সংস্কৃতির কাণ্ডারী। নজরুলের তিন উপন্যাস আজও আমাদের অবশ্যপাঠ্য।
Book Name : | উপন্যাসসমগ্র । কাজী নজরুল ইসলাম |
Authors : | কাজী নজরুল ইসলাম |
Publisher: | Inhouse book |
Edition: | 1st Edition August 2024 |
ISBN Number: | 978-984-98947-8-0 |
Total Page | 320 |
স্বাধীনতা, মানবতা, প্রেম ও বিপ্লব ছিল তাঁর অনন্য সাধারণ সাহিত্যের মূল সুর। লেখক হিসেবে ছিলেন মৌলবাদ, বর্ণবাদ, লিঙ্গবিদ্বেষ ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রতিটি সংগ্রামে, আন্দোলনে, বিশেষত মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি। কাজী নজরুল ইসলাম। জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে, পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায়। বাংলা সাহিত্যের চিরবিদ্রোহী কবি হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও নজরুল ছিলেন একাধারে সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, রাজনীতিবিদ, গায়ক ও অভিনেতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টনের সৃষ্টিশীল সৈনিক নজরুল ‘লাঙল’, ‘নবযুগ’ ও ‘ধূমকেতু’র মতো সংবাদপত্রও সম্পাদনা করেছেন। কবিতার জন্য গিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদীর কারাগারে। আদর্শের বলে লড়েছেন নির্বাচনে। অসংখ্য বিচিত্র রাগ-রাগিণীর স্রষ্টা সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে রচেছেন তিন হাজারের বেশি গান। দেশাত্মবোধক গান, শ্যামাসংগীত, গজলে তাঁর জুড়ি বাংলায় আজও নেই। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সম্মানসূচক ডি.লিট’, ভারতে ‘পদ্মভূষণ’, বাংলাদেশে ‘একুশে পদক’ ও ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত হন তিনি। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয় চিরবিদ্রোহী কবিকে।